| রবিবার, ১৬ মার্চ ২০১৪ | প্রিন্ট
১৬মার্চ: বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া কলকাতা টেলিগ্রাফকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে শেখ হাসিনার সরকারকে অবৈধ আখ্যা দিয়ে সমর্থন দেয়া বন্ধ করার জন্য ভারতের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন। সোনিয়া সরকারকে ইমেইলে সাক্ষাতকারটি দেন তিনি। রোববার টেলিগ্রাফের সাপ্তাহিক সাময়িকী ‘সেভেন ডেজ’ তা প্রকাশ করা হয় ‘বাংলাদেশ উইল নেভার বি এ সেইফ হেভেন ফর মিলিটেন্টস’ শিরোনামে।
সাক্ষাতকারে খালেদা জিয়া বলেন, ভারতের গণতন্ত্রের দীর্ঘ ও গর্বিত ইতিহাস রয়েছে। তাই তাদের উচিত বাংলাদেশের জনগণের সাথে থাকা। কারচুপি এবং জনগণের প্রত্যাখ্যাত নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় থাকা সরকারের প্রতি সমর্থন দিয়ে ভারত বাংলাদেশের জনগণের থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নিচ্ছে।
সাক্ষাতকারটি তুলে ধরা হলো স্বাধীনদেশ পাঠকদের জন্য :
প্রশ্ন : আপনি কেন ২০১৪ সালের সংসদ নির্বাচন বয়কট করলেন?
খালেদা জিয়া : আমরা নীতিগত কারণে নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। আওয়ামী লীগ সরকার ২০১১ সালের মে মাসে হিসাবি পদক্ষেপ হিসেবে সাধারণ নির্বাচন তদারকির জন্য নিরপেক্ষ, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাংবিধানিক ব্যবস্থা-সংবলিত ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করে এবং এক মাস পর পঞ্চদশ সংশোধনী আনে, যার ফলে সংসদ বহাল রেখে রাজনৈতিক সরকারের অধীনে নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হয়। এর প্রতিক্রিয়ায় আমরা নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধাšত্ম নেই।
বিএনপির পাশাপাশি বাংলাদেশের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর বিরোধিতা করে। কারণ নির্বাচনে ব্যাপক মাত্রায় কারচুপির জন্য এমনটা করা হয়েছে বলে তাদের মনে গভীর সন্দেহের সৃষ্টি হয়। এটা বলা যথেষ্ট যে বাংলাদেশের জনগণ আমাদের অবস্থান সর্বাত্মকরণে সমর্থন করেছে, তারা ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচন পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করে। স্পিকার এবং বিরোধী দলের নেতাসহ সংসদের মোট আসনের অর্ধেকের বেশি আসনে নির্বাচন কমিশন ‘বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়’ জয়ী ঘোষণা করে। বাকি আসনগুলোর নির্বাচন ভোটারদের উপস্থিতি অত্যন্ত কম হওয়ায় তা দৃষ্টিকটু ধরনের প্রহসনে পরিণত হয়। বিশ্বস্ত সূত্র অনুযায়ী, ওইসব আসনে ভোটার উপস্থিতি ছিল পাঁচ শতাংশ।
প্রশ্ন : কিন্তু সংসদ নির্বাচন বয়কটের পর বিএনপি কেন উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে?
খালেদা জিয়া : কারণ সাদামাটা। প্রথমত, আমরা দাবি করেছিলাম যে সংসদ নির্বাচন হতে হবে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে, স্থানীয় সংস্থাগুলোর নির্বাচন নয়। দ্বিতীয়ত, স্থানীয় সংস্থাগুলোর নির্বাচন নির্দলীয় ভিত্তিতে হয়, যদিও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে সমর্থন কামনা করেন। তৃতীয়ত, স্থানীয় সংস্থাগুলোর নির্বাচনের ব্যাপ্তি হয় অনেক ছোট। ফলে নিরীক্ষণ করা অনেক সহজ। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, স্থানীয় নির্বাচনে সরকার পরিবর্তন হয় না।
প্রশ্ন : আপনার পরবর্তী চ্যালেঞ্জ কী? আপনি কি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে সংলাপের পক্ষে?
খালেদা জিয়া : পরের বড় চ্যালেঞ্জ তথা বিএনপি এবং এর ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক কর্মসূচির সর্বোচ্চ লক্ষ্য হলো বাংলাদেশের মানুষের ভোটাধিকার প্রয়োগের অধিকার এবং তাদেরকে তাদের নিজস্ব প্রতিনিধি মুক্তভাবে নির্বাচিত করার আকাক্সা বা¯ত্মবায়ন করা। শেখ হাসিনা কত দিন জনগণের প্রাণের দাবি অগ্রাহ্য করতে পারবেন? তাকে হয় জনগণের দাবির প্রতি সাড়া দিতে হবে, অন্যথায় তাকে স্বৈরতন্ত্রের আশ্রয়ে থাকতে হবে।
প্রশ্ন : মনে হচ্ছে না যে শেখ হাসিনা তার পাঁচ বছরের মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার আগে আবার নির্বাচনে যাবেন। আপনি কি বাংলাদেশ শাসন করার সুযোগ হাতছাড়া করেননি?
খালেদা : আওয়ামী লীগের অব্যাহতভাবে পাশ কাটানো এবং আপসহীন মনোভাব সত্ত্বেও বিএনপি সবসময় সংলাপের ব্যাপারে ইতিবাচকভাবে সব ঘরোয়া ও আšত্মর্জাতিক আহ্বানে সাড়া দিয়েছে। বাংলাদেশের জনগণের মতো বিএনপি বিশ্বাস করে যে অবাধ, নিরপেক্ষ, বিশ্বাসযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য প্রধান দলগুলোর মধ্যে অর্থপূর্ণ সংলাপ অনুষ্ঠান অপরিহার্য।
আমি উল্লেখ করতে চাই, আমার দল কিংবা আমি বাংলাদেশকে ‘শাসন’ করার ধারণায় বিশ্বাসী নই। আমরা দেশ ও জনগণের সেবায় বিশ্বাসী।
প্রশ্ন : ভারতে অনেকে বিশ্বাস করে যে আপনি ‘বন্ধু’ নন। আপনার ভারতবিরোধী ইমেজ কেন হলো?
খালেদা জিয়া : আমার দল ও আমি ব্যক্তিগতভাবে সব দেশ বিশেষ করে আমাদের প্রতিবেশীদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কে বিশ্বাস করি। আমরা আরো বিশ্বাস করি যে এ ধরনের সম্পর্ক হওয়া উচিত সার্বজনীনভাবে স্বীকৃত পারস্পরিক কল্যাণ ও শ্রদ্ধার মূলনীতির ভিত্তিতে।
আমাদের ঘনিষ্ঠতম প্রতিবেশী হিসেবে ভারতের সাথে আমাদের সম্পর্ক আরো বেশি তাৎপর্যপূর্ণ ও প্রাসঙ্গিক। ২০১২ সালের নভেম্বরে ভারত সরকারের আমন্ত্রণে আমার নয়া দিল্লি সফরের সময় আমাকে যখন উষ্ণভাবে স্বাগত জানানো হয়েছিল, তখন আমি ভারতের রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রতিটি পরিম-লে বিষয়টি বারবার উল্লেখ করেছি। আমার ধারণা সৃষ্টি হয়েছে যে বন্ধুত্ব ও পারস্পরিক কল্যাণকর সহযোগিতার যে আশ্বাস আমি দিয়েছিলাম, তা অত্যšত্ম প্রশংসিত হয়েছিল।
প্রশ্ন : কিন্তু তারপরও ইউপিএ সরকার শেখ হাসিনাকে সমর্থন দিয়েছে…
খালেদা জিয়া : গণতন্ত্রের দীর্ঘ ও গর্বিত ইতিহাসের অধিকারী ভারতের উচিত ১৯৭১ সালে আমাদের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় যেভাবে বাংলাদেশের জনগণের পাশে দাঁড়িয়েছিল, সে রকম অবস্থান গ্রহণ করা। কারচুপি এবং জনগণের প্রত্যাখ্যাত নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় থাকা সরকারের প্রতি সমর্থন দিয়ে বাংলাদেশের জনগণের থেকে ভারত নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখবে।
প্রশ্ন : নরেন্দ্র মোদি যদি ক্ষমতায় আসেন, তবে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক কেমন দেখতে চান আপনি?
খালেদা জিয়া : বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার সম্পর্ক কোনো ব্যক্তি বা কোনো বিশেষ রাজনৈতিক দলের ভিত্তিতে হওয়া উচিত নয়। এটা হওয়া উচিত দেশ দুটির জনগণের স্বার্থ আদায় এবং একে অন্যের উপলব্ধির প্রতি সাড়া দেয়ার ভিত্তিতে। ভারতের জনগণই ঠিক করবে, কে তাদের পরিচালনা করবে। আমাদের মধ্যকার সম্পর্ক আরো ঘনিষ্ঠ করার জন্য আমরা নির্বাচিত সরকারের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার ধারণায় বিশ্বাসী।
প্রশ্ন : হাসিনা সরকার অভিযোগ করছে যে আপনার সরকার উত্তরপূর্বাঞ্চলে ভারতীয় জঙ্গিদের আশ্রয় দিয়েছে।
খালেদা জিয়া : শেখ হাসিনার মন্তব্য ভিত্তিহীন, অসত্য ও স্পষ্টভাবেই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। ২০১২ সালে ভারতীয় নেতৃবৃন্দের সাথে আমার বৈঠককালে আমি তাদের আশ্বাস দিয়েছিলাম যে বাংলাদেশের ভূখ- ভারতের স্বার্থের বিরুদ্ধে কিংবা ভারতের নিরাপত্তা প্রতি হুমকি সৃষ্টি হতে পারে, এমন কোনো কাজে ব্যবহার করতে দেয়া হবে না। বাংলাদেশ অতীতেও কখনো জঙ্গিদের নিরাপদ আশ্রয়কেন্দ্র ছিল না, ভবিষ্যতেও থাকবে না।
প্রশ্ন : কিন্তু আওয়ামী লীগ দাবি করছে যে বিএনপি এবং এর প্রধান মিত্র বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী আল-কায়েদার প্রতি বন্ধুত্বপূর্ণ, যা বাংলাদেশে ইন্তিফাদা সৃষ্টির হুমকি সৃষ্টি করেছে।
খালেদা জিয়া : কোনো সন্ত্রাসী হুমকি হালকাভাবে নেয়া উচিত নয়। আবার কারো সেটা সংকীর্ণ রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের উদ্দেশ্যে ব্যবহার করাও উচিত নয়। ব্লেম গেম আত্ম-বিধ্বংসী কাজ। বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদকে গুরুত্ব দিয়ে গ্রহণ করা উচিত। এই হুমকি সমন্বিতভাবে মোকাবিলার প্রস্তুতি থাকা দরকার। আমাদের বহুমাত্রিক সমাজে সন্ত্রাসবাদ বা জঙ্গিবাদের কোনো স্থান নেই। বিএনপি সব ধরনের সন্ত্রাসবাদের নিন্দা জানায় এবং এর তীব্র বিরোধী। অতীতে বিএনপি সরকার সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে কাজ করেছে- এমন প্রমাণ রয়েছে। ২০০৫ ও ২০০৬ সালে বিএনপি সরকার ১,১৭৭ জন সন্ত্রাসী ও চরমপন্থীকে গ্রেফতার করেছে।
১৯৯৬ থেকে ২০০১ সালে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নতুন নতুন সন্ত্রাসী গ্রুপের আবির্ভাব ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে হামলার ঘটনা ঘটেছিল।
বিএনপি ও বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর রাজনৈতিক দর্শনের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। জামায়াতের সাথে আমাদের সম্পর্ক নির্বাচনী মিত্রতা। অবশ্য জামায়াত এবং অন্যান্য প্রধান রাজনৈতিক দলের মধ্যে রাজনৈতিক জোটবদ্ধতার ইতিহাসও রয়েছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ১৯৮০ ও ১৯৯০-এর দশকে জামায়াতের সাথে আওয়ামী লীগ ঘনিষ্ঠ মিত্রতার সম্পর্ক রেখেছিল। এই আওয়ামী লীগই ২০০৬ সালে মৌলবাদী দল বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের সাথে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেছিল। ওই সমঝোতা স্মারকের লক্ষ্য ছিল ধর্মীয় ফতোয়ার বৈধতাকরণ।
প্রশ্ন : যুদ্ধাপরাধীদের শা¯িত্মর জনপ্রিয় আন্দোলন রয়েছে। বিএনপি ক্ষমতায় এলে যাবজ্জীবন দ-প্রাপ্তদের মুক্তি দিয়ে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করবে বলে সাধারণভাবে বিরাজমান ধারণাটা কতটা সত্য?
খালেদা জিয়া : আমরা বিশ্বাস করি যে যে-ই মানবতাবিরোধী অপরাধ করে থাকুক না কেন, তাকে জবাবদিহি করতে হবে এবং তাকে আইনের সামনে হাজির হতে হবে। বিএনপি স্বচ্ছ এবং আšত্মর্জাতিক মানদ- পূরণকারী প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশে মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার করবে।
প্রশ্ন : সম্প্রতি আপনার ও শেখ হাসিনার মধ্যে ‘টেলিফোনিক’ সংলাপ ব্যাপকভাবে আলোচিত হতে দেখা যাচ্ছে। এটা কি বাংলাদেশের দুই শীর্ষ নেতার মধ্যকার ব্যক্তিত্বের সঙ্ঘাতকে প্রকট করেনি?
খালেদা জিয়া : টেলিফোন সংলাপটি ছিল দেশের শীর্ষ দুই রাজনৈতিক নেতার মধ্যকার বিশেষ সুযোগ। এটাকে সেভাবে বিবেচনা করা উচিত ছিল। সরকারের এটা প্রকাশ ছিল অযথার্থ, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং একইসাথে বিশ্বাসভঙ্গ।
প্রশ্ন : বিএনপি এখন কোন দিকে নজর দিচ্ছে?
খালেদা জিয়া : আমাকে পরিশেষে বলতে দিন যে আমরা যদি বিশৃঙ্খলা ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এড়াতে চাই, তবে বাংলাদেশের জন্য গণতন্ত্র, আইনের শাসন, মানবাধিকার এবং সুশাসন অত্যšত্ম গুরুত্বপূর্ণ। গণতান্ত্রিক, শাšিত্মপূর্ণ ও রাজনৈতিক স্থিতিশীল বাংলাদেশ কেবল আমাদের নয়, আমাদের এই অঞ্চলের স্বার্থের জন্যও দরকার।
Posted ২০:১৭ | রবিবার, ১৬ মার্চ ২০১৪
Swadhindesh -স্বাধীনদেশ | admin